সমস্যা হল প্রাচীন কোনো স্থানীয় বিবরণের ইতিহাস এখনো পাওয়া যায়নি। তাই আমাদের নির্ভর করতে হয় সমসাময়িক অন্যান্য সাহিত্য বা বিভিন্ন সময়ে আসা পর্যটকদের উপর।
আমরা পাড়ি দেবো তমলুকের প্রাগতৈহাসিক যুগে,কিন্তু তার আগে এই লেখায় থাকলো তমলুকের নামকরণের ইতিহাস।
ষোড়শ শতকের প্রাচীন ভৌগলিক গ্রন্থ 'দিগ্বিজয় প্রকাশে' নামকরণ এর নেপথ্যে একটি গল্প আছে। যখন বৃন্দাবনে বাসুদেব রামলীলা করছিলেন, সে সময় তার ইচ্ছেতে চন্দ্র সূর্যের স্তম্ভন হয়েছিল, মানে দিনরাত্রির গতি থামিয়ে দিয়েছিল। পরে সূর্যদেব সারথিকে বলেছিলেন আমি ভারতকে দিন করবো,তুমি উদয়াচল থেকে তাড়াতাড়ি এসো। সারথি রশ্মি নিয়ে এলে জ্যোতস্না চলে গেলো, সূর্যরশ্মি (তাম্রবর্ণ) দূর হতে সমুদ্রপ্রান্তে পড়লো, যেখানে পড়লো,তার নাম হল তাম্রলিপ্ত। প্রসংগত, নানা লেখা থেকে বোঝা যায় তাম্রলিপ্ত ছিল সেই সময় হুগলী নদীর মোহনায়, পূর্বতম প্রান্তে প্রথম বন্দর। তাই প্রথম সূর্যরশ্মি এখানেই পড়বে,স্বাভাবিক।
আবার অন্য একটি প্রাচীন বৈষ্ণব পুথি থেকে জানা যায়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন রাসলীলায় মগ্ন ছিলেন,তখন সূর্যদেব পূর্বদিক থেকে উদয় হন এবং শ্রীকৃষ্ণকে শ্রীরাধিকার সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে লজ্জা পেয়ে তাম্রবর্ণ এর রশ্মি বিকিরণ করে পূর্বদিকে বংগোপসাগরে লুকিয়ে(লিপ্ত হন) যান। এই জায়গাটির নাম হয় তাম্রলিপ্ত।
বলা বাহুল্য ষোড়শ শতক থেকে তমলুকে বিষ্ণু ধর্ম ভালোমতই প্রতিষ্ঠিত,তাই পরবর্তী সময়ে নামকরণ এর নেপথ্যে কৃষ্ণ এর নাম বারবার এসেছে,এমনকি তমলুকের অন্যনাম তাই বিষ্ণুগৃহ।
মহাভারতে নানা অধ্যায়ে আমরা বারবার তাম্রলিপ্ত বা তাম্রলিপ্তির উল্লেখ পাই এবং বর্ননা অনুসারে এখানে রাজা ছিলেন তাম্রধ্বজ। স্থানীয় মতে এই তাম্রধ্বজ রাজার নাম থেকেই তাম্রলিপ্ত নাম হয়েছে।
তবে তাম্রলিপ্ত নামের সম্ভাব্য কারণ তামা। তাম্রযুগে অর্থাৎ সিন্ধুসভ্যতার সময়ে ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকেই তামা উতপাদন হত এবং নিষ্কাসন এর পরে নানা জায়গায় তামা রপ্তানি হত। আজও এই অঞ্চল থেকে তামা উত্তোলন হয় এবং সেই সময়ের খনি পাওয়া যায়। এই তামা রপ্তানির মূল বন্দর ছিল তাম্রলিপ্ত। শুধু তামা রপ্তানির জন্য নয়, পচন রক্ষা থেকে বাচানোর জন্য জাহাজের কাঠের খোলে তামা লেপে দেওয়া হত (মতান্তরে তামার পেরেক মারা হত) এই বন্দরে। তাই নাম ছিল তাম্রলিপ্ত, এখান থেকেই রাজার নামও হয় তাম্রধ্বজ।
আবার পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই মতের সাথে একমত হতে পারেন না। তার মতে তাম্রলিপ্ত সংস্কৃতি নাম,এর আগে নাম ছিল দামালিপ্ত অর্থাৎ দামল বা তামিল জাতির নগর। তার মতে চন্দ্রগুপ্তের বহু আগে তামিলরা যে বংগদেশে বাস করতেন,তার প্রমাণ আছে এবং তারা নৌকাবিদ্যায় পটু ছিল। সেই সময় থেকেই তাম্রলিপ্ত বড় বন্দর ও বাণিজ্য নগর। ঐতিহাসিক দীনেশ চন্দ্র সেন এই দাবীর সাথে একমত হয়ে বলেছেন মেদিনীপুর জেলা থেকে 'দামল' জাতিই দক্ষিণ দেশে গিয়ে তামিল নামে পরিচিত হয়েছে। প্রসংগত তাম্রলিপ্তি পালি ভাষায় তামলিপটি লেখা হত,সেখান থেকেও তামিল শব্দটা আসতে পারে।
পন্ডিত কনকভাই এর মতেও মংগোলিয়ান উপজাতিরা ভারতবর্ষে এসে প্রথমে গংগার মোহনায় তামালিত্তি নামে শহর বন্দর গড়ে তোলে,পরে তারা আরও দক্ষিণে চলে যায় ও তামিল নামে পরিচিত হয়।
তবে এই শহরের নাম কোথাও পাওয়া যায় তমোলিপ্ত নামে। তমঃ অর্থাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন, লিপ্ত অর্থাত আচ্ছন্ন।
স্থানীয় লেখক ত্রৈলোক্যনাথ রক্ষিতের মতে সম্ভবত হিন্দু ধর্মের পূর্বে দীর্ঘদিন যাবত তাম্রলিপ্তি বৌদ্ধদের (মতান্তরে অনার্যদের) হাতে ছিল,তাই হিন্দুরা বিকৃত করে এর ঘৃণাসূচক নাম রাখে তমোলিপ্ত। পরে যখন তাম্রলিপ্ত হিন্দুদের হস্তগত হয় তখন ব্রাম্ভ্রণ ধর্মশাস্ত্রের অন্তর্গত হয়। পুরাণের গল্পে এর উল্লেখ রয়েছে, বিষ্ণু কল্কিরূপ ধারণ করে অসুরদের ধ্বংস করে, সেই সময় যুদ্ধাশ্রমে শরীরের ঘাম বের হয়ে মাটিতে পড়লে তাম্রলিপ্ত তার পূণ্যতা অর্জন করে। আজ আবার সুকুমার সেন সহ অনেক ঐতিহাসিক,ভাষাবিদের মতে অষ্ট্রোলয়েড জাতির আদি বাসিন্দাদের অসুর বলে চিহ্নিত করা হয়েছে পুরাণে।
এবারে আমরা পাড়ি দেবো তমলুকের ইতিহাসে,ফলো করতে থাকুন আমাদের পেজ, ব্লগ।