শনিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬

প্রাগৈতিহাসিক পর্ব ১: প্রাচীন প্রস্তর যুগে তাম্রলিপ্ত

এই সেই বিশাল মহাবিশ্বের খানিক অংশের ছবি, খুব কষ্ট করে খোজার চেষ্টা করলে হয়তো পেতে পারেন একটি ধূসর নীল বিন্দু, আমাদের পৃথিবী, আমাদের যাবতীয় অহংকার, গর্ব, ইতিহাস, দর্শন, জয় পরাজয়, ঘৃণা, সবকিছু, সবকিছুই রয়েছে এই ছোট্ট নীল বিন্দুতে, মহাজাগতিক সময়ের তুলনায় কিছু মূহুর্তের জন্য।
মহাবিশ্ব পৃূথিবী থেকে
370 কোটি মাইল দূর  থেকে পৃথিবীর তোলা ছবি

বিজ্ঞানী
রা ধারনা দেওয়ার জন্য মহাজাগতিক সময়কে এক বছর ধরে সুন্দর একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করেছে, যেখানে এক সেকেন্ড মানে ৪৩৭.৫  বছর, এক ঘন্টা মানে ১৫.৭৫ লক্ষ বছর, একদিন মানে সাইত্রিশ কোটি আশি লক্ষ বছর।
কসমিক ক্যালেন্ডার 

এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১লা জানুয়ারি রাত ১২ টায় বিগব্যাং বা মহা বিস্ফারণ এর মাধ্যমে আমাদের এই মহাবিশ্ব তৈরি শুরু হয়েছিল, মে মাসে তৈরি হল ছায়াপথ, সেপ্টেম্বরে তৈরি হল আমাদের এই সৌরমণ্ডল ও পৃথিবী, অক্টোবর মাসে পৃথিবীতে এল সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতি, ডিসেম্বরের ২০ তারিখে জলে এল মাছ, ২৫ তারিখ এল ডাইনোসরেরা,৩০ তারিখ ডাইনোসরেরা বিলুপ্ত হয়ে যায়, ৩১ তারিখ রাত ১১টা ৫২ মিনিটে আধুনিক মানুষের আবির্ভাব হয়। ১১টা ৫৯ অব্দি ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়া চলে। এবং যাবতীয় কৃষিকাজ উদ্ভাবন, বাসস্থান তৈরি,  যুদ্ধ বিগ্রহ, টেকনোলজির আবিষ্কার ঘটেছে এই শেষ এক মিনিটে। আপনার আয়ুষ্কাল এই মহাজাগতিক ক্যালেন্ডারে মাত্র ০.২৩ সেকেন্ড, চোখের পলক মাত্র!
পৃথিবী সৃষ্টির মুহূর্তে
প্রথম পর্যায়ে পৃথিবীর মানচিত্র আজকের মত ছিল না। চারশত চুয়ান্ন কোটি বছর আগে পৃথিবী তৈরির সময় ছিল জ্বলন্ত গ্যাসের পিন্ড, ক্রমে উপরের তল তাপ বিকিরণ করে ঠান্ডা হয় এবং অনেকটা দুধে সর পড়ার মত করে বাইরের আবরণ তৈরি হয়। সমগ্র ভূতল শেষবারের মতো একসাথে যুক্ত ছিল ২৪ কোটি বছর আগে, যার নাম ছিল প্যাঞ্জিয়া। এই প্যাঞ্জিয়ার দক্ষিণ অংশের নাম ছিল গন্ডোয়ানা,উত্তর অংশ লরেশিয়া। কিন্তু পৃথিবী নিজের অক্ষের উপর প্রতিদিন একচক্কর সম্পূর্ণ করে, ফলে অপকেন্দ্র বলের প্রভাবে গরম লাভার উপরে ভাসমান ভূপৃষ্ঠ ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। গন্ডোয়ানা প্রায় ১৮ কোটি বছর আগে ভাংতে শুরু করে, তখন স্থলভাগ দাপিয়ে বেড়চ্ছে ডাইনোসরেরা। একটি অংশ চলে যায় আরো দক্ষিণে,যাকে এখন চিনি আন্টার্টিকা হিসেবে, একটি অংশ চলে যায় পূর্বের দিকে,যা পরিচিত অষ্ট্রেলিয়া নামে, একটি অংশ চলে যায় পশ্চিমের দিকে,নাম হয় দক্ষিণ আমেরিকা, আরেকটি অংশ ভারত মহাসাগর ধরে পাড়ি দেয় সুদূর উত্তরে,যা পরিচিত ভারতবর্ষ হিসেবে। ৪.৫ কোটি বছর আগে এই গন্ডোয়ানার অংশ বা ভারত ভূখণ্ড এসে ধাক্কা মারে উত্তরের ইউরেশিয়া প্লেটকে। সংঘর্ষস্থলে জন্ম নেয় হিমালয় পর্বতমালা। তৈরি হল নদী, গংগা,সিন্ধু,ব্রম্ভ্রপুত্র। হিমালয়ের বিপুল পলিমাটি নিয়ে এসে এই ন্দীগুলো জমা করতে থাকে নদীখাতে। তৈরি করলো বিশাল সব সমভূমি। আমাদের তমলুক তথা তাম্রলিপ্ত এই গন্ডোয়ানারই অংশ, গাংগেয় সমভূমির উপরে গড়ে উঠেছে।
প্যানজিয়া থেকে ভারতের যাত্রা 

এবারে আসা যাক তাম্রলিপ্ত তথা ভারতবর্ষতে আধুনিক মানুষের আগমন প্রসংগে। ৩৫৫ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে প্রাণের আবির্ভাব হয়। এককোষী জীব থেকে বহুকোষী জীব হয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীর উদ্ভব হয়। বিবর্তনের ধারা বেয়ে অমেরুদণ্ডী প্রাণী থেকে মেরুদণ্ডী প্রাণী হয়ে আসে উভচর প্রাণী, সরীসৃপ প্রাণী ও সবশেষে আসে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা। স্তন্যপায়ীদের বিবর্তনের শেষ পর্যায়ে আসে  মহাবানরেরা (হোমিনিড), প্রায় সাড়ে আট কোটি বছর আগে, আমাদের আদিপুরুষেরা।
জীবজগতের  বিবর্তন

মানুষের বিবর্তন
আধুনিক মানুষকে বিজ্ঞনীরা ডাকেন হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স নামে। আমাদের সদ্য পূর্বপুরুষরা ছিল হোমো ইরেক্টাস, জন্মস্থান ছিল আফ্রিকা মহাদেশ, অন্তত ১৭ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে তারা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবী নানা সময়েই অত্যন্ত গরম হয়েছে, কখনো বা অত্যন্ত শীতল, সেইমতো প্রচণ্ড খাদ্যসংকট দেখা দেয়, যা তাদের বাধ্য করে নতুন বাসস্থান খুজে বের করতে। এই হোমো ইরেক্টাসরা দুপায়ে হাটতে পারতো, পাথরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারতো, আগুন জ্বালাতে পারতো,মাংস ঝলসে খেতো। প্রাচীন প্রস্তর যুগের সূচনা ঘটে এদেরই হাত ধরে।
ক্রমশঃ এরা বিবর্তিত হতে শুরু করে আফ্রিকার চরম পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য, আসে হোমো হাইডেলবার্গেনসিস,প্রায় ৬ লক্ষ বছর আগে। এশিয়ায় পরিবেশ এত ঘন ঘন পরিবর্তন হয়নি,ফলে এখানে ইরেক্টাসরা আর বিবর্তিত হয়নি ও একসময় বিলুপ্ত হয়ে যায়।

হোমো ইরেক্টাস ও তাদের যাত্রাপথ

হাইডেলবার্গেনসিসরাও আফ্রিকা ছেড়ে পাড়ি দেয় এশিয়া এবং ইউরোপে। সেই সাথে সহানুভূতি, সামাজিক দায়বদ্ধতা এরা ধীরে ধীরে রপ্ত করতে শুরু করে, লাল আকর ব্যবহার করে গুহাচিত্র আকা এরাই প্রথম শুরু করে। 
হোমো হাইডেলবার্গেনসিস ও গুহাচিত্র


বেচে থাকার লড়াইতে হাইডেলবার্গেনসিসরাও বিবর্তিত হয়। এই সময় জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনে আফ্রিকার উত্তরে সাহারা মরুভূমি তৈরি হয়, যা ইউরোপ আর আফ্রিকাকে আলাদা করে দেয়। ফলে প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকায় বিবর্তনের মাধ্যমে তৈরি হয় হোমো সেপিয়েন্স, ইউরোপে তৈরি হয় হোমো নিয়ান্ডার্থাল, এশিয়াতেও পৃথক বিবর্তন ঘটে,তৈরি হয় ডেনিসোভিয়ান। প্রায় একলক্ষ বছর আগে হোমো সেপিয়েন্সরা আফ্রিকা থেকে বাইরেও রওনা দেয়। বাকি প্রজাতিদের সাথে আন্তঃপ্রজননও ঘটে। আমরা আজও এই তিনপ্রজাতির বৈশিষ্ট্য বহন করে চলেছি,যদিও হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স ছাড়া বাকিরা বিলুপ্ত হয়ে যায় সেই দশহাজার বছর আগে।
হোমো নিয়ান্ডার্থাল ও  হোমো সেপিয়েন্স

পূর্বপুরুষদের বিভিন্ন সময়ে যাত্রাপথ
আফ্রিকা থেকে এশিয়াতে আধুনিক মানুষের রওনা দুভাবে দিয়েছে, প্রথমটি ঘটে লোহিত সাগর পেরিয়ে জলপথ ধরে দক্ষিণ ভারত ধরে অষ্ট্রেলিয়ায় (এদেরই একটি অংশ অবিকৃত অবস্থায় আজও রয়েছে আন্দামানে), পরেরটি ঘটে স্থলপথে সুয়েজ পেরিয়ে চীন হয়ে ভারতে আগমন। ভারতে হোমো সেপিয়েন্স আসে প্রায় ৬০ হাজার বছর আগে।
আধুনিক মানুষের দুই যাত্রাপথ

আমরা বিশেষ নজর রাখবো,যারা জলপথে ভারতে এসেছিল, তারা নৌবিদ্যায় বিশেষ দক্ষ ছিল এবং তাদের যাত্রাপথে স্পষ্টতই তাম্রলিপ্ত পড়ছে। তাম্রলিপ্তর আদি বসতি গড়ে উঠেছিল এদেরই হাত ধরেই, অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসিন্দাদের সাথে তাই ভারতে থেকে যাওয়া জনজাতির অদ্ভুত জিনের মিল পাওয়া যায় (পরের কোনো লেখায় জানাবো ভারতে কোন জনজাতি)। আজও মেদিনীপুর এর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে (বিশেষত গেওয়াখালির অদূরে নাটশাল গ্রাম থেকে) প্রাচীন প্রস্তর যুগের অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হয়ে চলেছে,যাদের মধ্যে আছে কাটারি, হাত কুঠার ইত্যাদি। খাদ্য সংগ্রহ আর শিকার করেই তখনকার মানুষদের বেচে থাকতে হত। তমলুক মিউজিয়ামে আজও উদ্ধার হওয়া প্রাচীন প্রস্তর যুগের অস্ত্রগুলো গেলে দেখতে পাওয়া যাবে।
এরকম ধরনের নৌকা নিয়েই আমাদের পূর্বপূরুষরা প্রথম সমুদ্রে রওনা দিয়েছিলেন
প্রাচী প্রস্তর যুগের অস্ত্রশস্ত্র
 প্রাচীন প্রস্তর যুগের বসতি

(চলবে)



৬টি মন্তব্য:

  1. Very enlightening especially the section of human evolution..keep it up friend..

    উত্তরমুছুন
  2. ধন্যবাদ দীপময়,এই তমলুক তো আমাদেরই শহর,সবাই মিলে এই শহরকে চেনার চেষ্টা করবো আরেকটু বেশী করে। সকলের সহযোগীতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

    উত্তরমুছুন
  3. ধন্যবাদ, আমাদের লেখা মিস করতে না চাইলে ব্লগ সাবস্ক্রাইব করতে পারেন, ব্লগ সাবস্ক্রাইব করার অপশন ওয়েব ভার্সানে পাবেন।

    উত্তরমুছুন